একটি নদীর আত্মকাহিনি
ভূমিকা: আমিই সেই নদী, যাকে ভারতবাসী ‘দেবী’ বলে শ্রদ্ধা করে। আমার প্রবাহিত জলধারা সকলের কাছে পবিত্র। আমার জল অপবিত্রকে পবিত্র করে, পতিতকে উদ্ধার করে। এমনকি আমার জলে স্নান করাটাকে লােকে পরমপুণ্য বলে বিবেচনা করে। যুগ যুগ ধরে বহু মনীষী, বহু কবি আমাকে বন্দনা করে কবিতা এবং স্তোত্র রচনা করেছেন। আমি হলাম ‘গঙ্গা। তবে দেবলােকে এই আমিই হলাম ‘অলকানন্দা’ ও ‘মন্দাকিনী’ এবং পাতালে ‘ভােগবতী।
আমার গতিপথ : হিমালয়ের গঙ্গোত্রী ‘হিমবাহ থেকে আমার জন্ম এবং সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু। উত্তর ভারত এবং আর্যাবর্তকে অতিক্রম করে দু-হাজার পাঁচশাে কিলােমিটার পথ পেরিয়ে গৌড়বঙ্গে প্রবেশ করে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে আমি সাগরে এসে মিশেছি। উত্তর ও মধ্য ভারতে আমিই প্রধান নদী। দক্ষিণ ভারতে গােদাবরী, নর্মদা, কৃষ্ণা ও কাবেরী রয়েছে এবং ওড়িশায় রয়েছে মহানদী। কিন্তু আমার মতাে এতখানি দীর্ঘপথ অতিক্রম তারা করেনি। এই নদীগুলিও পবিত্রসলিলা এবং প্রাচীন।
আমার পৌরাণিক পরিচয় : আমি বহু প্রাচীনকাল থেকে আর্যভূমিতে প্রবাহিত হচ্ছি। তাই বহু প্রাচীন ও পৌরাণিক কাহিনি গড়ে উঠেছে আমাকে নিয়ে। স্বর্গ থেকে আমার অবতরণ নিয়ে রয়েছে অনেক আখ্যান। তার ভিতর রয়েছেন স্বয়ং মহাদেব, রয়েছে তাঁর জটাজাল। রয়েছে ঐরাবতের গল্প। রয়েছে রাজা শান্তনু এবং ‘অষ্টবসু’-র কাহিনি। মহাভারতের ভীষ্ম আমার সন্তান বলে বিখ্যাত ও প্রচারিত। আমার গতিপথে ছিল ‘জহ্নুমুনি’রআশ্রম। এই আশ্রমটি আমার উদ্দাম জলপ্রবাহে ভেসে যায়। সেই রাগে জহ্নুমুনি আমাকে পান করে ফেলেন। তা শেষপর্যন্ত জানু চিরে তিনি আমাকে আবার বের করে দেন। তখন থেকে আমার নাম হয় ‘জাহ্নবী’।
তীরে তীরে নগর, ঘাট, নদীবন্দনা, যমুনার সঙ্গে সংগ্রাম : সারা ভারতজুড়ে আমার তীরে তীরে গড়ে উঠেছে অনেক স্নানের ঘাট। তীরে তীরে দেখা যায় অনেক গাছপালা, অরণ্য, তীর্থস্থান। ওইসব তীর্থস্থানগুলির ভিতর বিশেষ উল্লেখ্য হল হৃষীকেশ, হরিদ্বার, বারাণসী, প্রয়াগ। হরিদ্বারের হর-কা-পৌরি’ খুবই বিখাত। বারাণসীর তীরে অজস্র ঘাট। সেখানে ‘দশাশ্বমেধ ঘাট’-এর চত্বরে প্রতি সন্ধ্যায় আমার আরতি হয়। প্রয়াগ’ তীর্থেও আমার প্রশস্তি পাঠ হয়, এখানে ‘যমুনা’-এর সঙ্গে আমার মিলন হয়েছে। আমাদের ‘মিলন সংগম’-এ পুণ্যার্থীরা স্নান করে। ত্রিবেণী হল বড়াে তীর্থস্থান।
নদীতীরে শ্মশান : আমার গতিপথের তীরে তীরে রয়েছে অনেক শ্মশান। ওইসব শ্মশানে মানুষের মৃতদেহ দাহ করা হয়। গঙ্গার তীরে মৃতদেহ দাহ করলে তার আত্মার সদ্গতি হয়। কাশীধামের মণিকর্ণিকার শ্মশানে স্বয়ং মহাদেব মৃতের কানে কানে মন্ত্র পাঠ করে দেন, এই রকমই প্রবাদ।
তীরে চাষবাস, জলযান : আমার তীরে তীরে যেসব জমি রয়েছে, তা খুবই উর্বর। এইসব জমিতে প্রচুর ফসল ফলে। প্রচুর ধান, গম এবং আখ হয়। যখন এদেশে রেল আসেনি তখন সকলে নৌকো-বজরাতেই যাতায়াত করত এবং এখনও তা করে। তবে এখনকার মােটরচালিত। লঞ্চগুলি অনেক দ্রুতগামী।
সামরিক দুর্গ : আমার তীরে তীরে বহু সমৃদ্ধ নগরী গড়ে উঠেছে। হরিদ্বার, বারাণসী, এলাহাবাদ, পাটনা, কলকাতা হল এই ধরনের সমৃদ্ধ নগর। ওইসব নগরীর সঙ্গে গড়ে উঠেছে অনেক সামরিক দুর্গও। এলাহাবাদ, পাটনা ও কলকাতায় ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ হল এই ধরনের দুর্গ।
উপসংহার : আমার দীর্ঘ যাত্রাপথে অনেক ছােটো ছােটো নদী এসে মিশেছে আমার সঙ্গে। তবে আমার দুঃখ কিছু রয়েছে। ইদানীং কালে, আধুনিক কলকারখানার নােংরা জল এবং নগর-নগরীর নর্দমার মলিন জল এসে মিশেছে আমার প্রবাহে। তাতে দূষিত হচ্ছে আমার জল। এটি একটি বিরাট সমস্যা। এই সমস্যা দূর করার জন্য তৈরি হয়েছে ‘গঙ্গাদূষণ’ পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানাই।
আরো পড়ুন
একটি শহরের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি বটগাছের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি ভাঙ্গা ছাতার আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি রাজপথের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
প্রতিযোগিতার সুফল ও সংকট – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।